শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা। তবে তিনি না ফেরার দেশে চলে যাওয়ার পর সেই দলের হাল ধরেন তার সহধর্মিনী বেগম খালেদা জিয়া। শুধু তাই নয় তিনবারের সফল প্রধানমন্ত্রীর তকমাও তার নামের পাশে লেগে যায়। তবে জিয়াউর রহমান এর জীবনী নিয়ে বিভিন্ন সময় আলোচনা হয়ে থাকে তারই ধারাবাহিকতায় সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন সাফি মোহাম্মদ খান। নিচে তার স্ট্যাটাসটি তুলে ধরা হল –
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হয়েছিলেন এক চল্লিশ বছর আগে তারই রণাঙ্গনের সহযোদ্ধা মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুরের নেতৃত্বাধীন সৈনিকদের হাতে। কেন জিয়াকে প্রাণ দিতে হয়েছিল সে কারণ আজও স্পষ্টভাবে জানা যায়নি। জিয়ার হত্যার সঙ্গে সেনাবাহিনীর যারা জড়িত ছিলেন তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হলেও এ অভ্যুত্থান ষড়যন্ত্রের পর্দা উন্মোচিত হয়নি।
ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত, নিয়তির বরপুত্র, আধুনিক বাংলাদেশের আইকন জিয়াউর রহমানকে ভবিষ্যৎ কীভাবে মূল্যায়ন করবে? এ প্রশ্নের জবাব জরুরি এই কারণে যে, মৃত্যুর অব্যবহিত পরে নয়, রাজনৈতিক বিভাজন বেড়ে যাওয়ায় গত এক দশকে বিভিন্নভাবে জিয়ার চরিত্র হননের চেষ্টা হয়েছে। একসময় জিয়ার মৃত্যুকে যারা দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন তারা যোগ দিয়েছেন এই চরিত্র হননের প্রতিযোগিতায়, যার আদৌ কোনো প্রয়োজন ছিল না।
ব্যক্তিগতভাবে জিয়া কারও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নন। তার রাজনীতিই তাকে প্রতিপক্ষের আসনে বসিয়েছে। এ রাজনীতিকে বাংলাদেশের বিকাশের বাস্তবতায় বিচার করলে আলোচনা অনেক সহজ পথে এগোবে। জিয়া জন্মেছিলেন ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে। তার জন্মের এক দশক পরই ভারতবর্ষে জন্ম নেয় দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র- পাকিস্তান ও ভারত। আর তার জন্মের তিন দশকেরও বেশি সময় পর স্বাধীনতা লাভ করে বাংলাদেশ-যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার নাম।
দুটি ঘটনাই জিয়ার জীবনকে প্রভাবিত করেছে, পরিচালিত করেছে তার বেড়ে ওঠাকে। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ না হলে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন না হলে জিয়ার পরিণতি কী হতো তা কেউ জানে না। অবশ্য এ ধরনের যদি বা কল্পনা দিয়ে ইতিহাস, রাজনীতি এসবের আলোচনা করা যায় না।
জিয়া হচ্ছেন ইতিহাসের হাতেগোনা জেনারেলদের একজন- যিনি অফিসার হিসেবে মাতৃভূমির জন্য দুটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ করেছেন এবং জেনারেল পদে উন্নীত হয়েছেন। দুটি যুদ্ধই জিয়ার জীবনকে দিয়েছে গৌরবের মর্যাদা।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণের ফলে জিয়ার মনোজগতে এসেছিল ব্যাপক পরিবর্তন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, স্বাধীনতাকে অর্থবহ করতে হলে জনগণের কাছে ফিরে যেতে হবে, তাদের নিয়ে আসতে হবে আলোর জগতে। এজন্যই তিনি চেষ্টা করেছেন বাংলাদেশের প্রায় প্রত্যেক জনপদে পৌঁছাতে, প্রত্যেক মানুষের মনোজগতে তার চিন্তার প্রভাব ফেলতে। এ কারণেই তিনি চেয়েছেন রাজনীতিকে মানুষের কাছে নিয়ে যেতে, যাতে তাদের আর রাজনৈতিক নেতা বা প্রভুদের ড্রয়িংরুমে আসতে না হয়। এ চিন্তা রাজনীতিবিদদের অসন্তুষ্ট করেছিল, যে কারণে আজও তারা জিয়ার এ উদ্যোগের সমালোচনায় মুখর।
বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার পথচলায় যেসব নিয়মনীতি, প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে তার শুরুটা জিয়ার হাত ধরেই। জাতীয় জীবনের এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে তার উপস্থিতি নেই। সেই উপস্থিতির স্থাপনাফলক হয়তো অনেক ক্ষেত্রেই লুকিয়ে ফেলা হয়েছে; কিন্তু ইতিহাস কি এত সহজে মুছে ফেলা যায়?
ঢাকায় একসময় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি মাইলাম লিখেছেন, জিয়া যদি ১৯৮১-এর পরিবর্তে ১৯৭৫ সালে নিহত হতেন তাহলে বাংলাদেশ আফগানিস্তান অথবা লাইবেরিয়ার মতো একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র হয়ে যেতে পারত। মাইলাম লিখেছেন, অবশ্য সেনা শাসকদের মতো কঠোর পদ্ধতিতে নয়, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে জিয়া বাংলাদেশকে ওই অবস্থা থেকে রক্ষা করেছেন।
জাতীয় জীবনে যেমনি, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও জিয়ার আমলেই বাংলাদেশ প্রথম মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৪ সালে যে দেশটি জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে, মাত্র চার বছরের ব্যবধানে ১৯৭৮ সালে জিয়ার আমলে সে দেশটিই জাপানের মতো রাষ্ট্রকে পরাজিত করে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য নির্বাচিত হয়েছিল। এ বিজয় কোনো দয়ার দান ছিল না, ছিল কূটনীতির বিজয়।
শুধু কি নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্যের পদে নির্বাচন? পৃথিবীর সব উল্লেখযোগ্য আন্দোলন ও কূটনৈতিক কার্যক্রমে বাংলাদেশ ছিল সক্রিয়ভাবে উপস্থিত।
আঞ্চলিক সহযোগিতাকে অর্থনৈতিক অগ্রগতির সোপান ভেবেছিলেন বলেই জিয়া চেয়েছিলেন সার্ক গঠন করতে। জীবদ্দশায় এর বাস্তবায়ন দেখে যেতে না পারলেও তার সেই স্বপ্নপূরণ হয়েছে। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি অঞ্চলে জিয়া গেছেন বাংলাদেশের স্বপ্নের ফেরিওয়ালা হিসেবে। প্রতিপক্ষকে মুগ্ধ করেছেন দেশের প্রতি নিজের অঙ্গীকারকে তুলে ধরে।।
এ কারণেই তার মৃত্যুর পর কিউবা, মিসর এবং মালদ্বীপ তিন দিনের এবং নেপাল দু’দিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালন করেছে। বাংলাদেশের অন্য কোনো নেতার মৃত্যুতে এমন ঘটনা ঘটেনি।
জিয়ার কর্মের ও অবদানের তালিকা অনেক দীর্ঘ। কিন্তু যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে, তা হল; ইতিহাস জিয়াকে কীভাবে দেখবে- একজন জেনারেল, একজন রাজনীতিবিদ অথবা একজন রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে।
তিনটি পরিচয়ই জিয়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, কেননা ‘তোমার পায়ের পাতা সবখানে পাতা’।
সামরিক শিক্ষা, সৈনিক জীবন, যুদ্ধে অংশগ্রহণ সব মিলিয়ে জিয়া আপাদমস্তক একজন জেনারেল। জেনারেল হিসেবে তিনি নিজ দেশের সেনাবাহিনীকে কমান্ড করেছেন। রাষ্ট্রভাষা বাংলার প্রতি সম্মান দেখিয়ে সেনাবাহিনীর কমান্ডের ভাষাকে পরিণত করেছেন বাংলায়।
সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ, সেনাবাহিনীর মানোন্নয়ন, আয়তন বৃদ্ধি, সেনানিবাসে শিখা অনির্বাণ প্রজ্বালন সবই তার হাতে শুরু হয়েছে। সেনাবাহিনীর সদস্যদের জন্য ভালোবাসাই তাকে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর ফিরিয়ে এনেছে ক্ষমতার কেন্দ্রে।
রাজনীতিবিদ হিসেবে জিয়ার পরিচয়ের নতুন কোনো প্রয়োজন নেই। তিনি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন, জাতীয় জীবনে সমন্বয়ের রাজনীতি করতে চেয়েছেন এবং বিরোধী রাজনীতিবিদদের প্রতি দেখিয়েছেন সম্মান। তার কারণেই গঠিত হয়েছিল বাংলাদেশের প্রথম রংধনু পার্লামেন্ট। রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যের অনন্যতার কারণেই তার দল তার অবর্তমানে দুবার পূর্ণ মেয়াদে দেশ শাসন করেছে এবং শত বিপর্যয়ের মাঝেও এখনও ব্যাপক জনভিত্তি নিয়ে গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করছে।
কিন্তু জেনারেল বা রাজনীতিবিদের কোনোটাই জিয়ার সঠিক পরিচয় নয়। ইতিহাসে জিয়া অভিহিত হবেন একজন স্টেটসম্যান বা রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে।
রাষ্ট্রনায়কের বিভিন্ন সংজ্ঞা আছে। প্রথমেই যেটা বলা হয়, তা হচ্ছে একজন রাজনীতিবিদ শুধু পরবর্তী নির্বাচনের কথা ভাবেন। আর রাষ্ট্রনায়কের থাকে ভিশন, স্বপ্ন এবং তিনি ভাবেন ভবিষ্যৎ।