মাসুদ রানা বাংলাদেশের জনপ্রিয় একটি উপন্যাসের চরিত্র। আজ থেকে আরো ১০-১৫ বছর আগের কিশোরদের কৈশরটা কেটেছে এই মাসুদ রানার গোয়েন্দা গল্প পড়ে পড়ে। বিশেষ করে ৯০ এর দশকের সকল কৈশরদের কাছে মাসুদ রানা একটি জনপ্রিয় নাম। এবার পর্দার এই মাসুদ রানার সাথে বাস্তবের গোয়েন্দাদের নিয়ে একটি ধারাবাহিক লেখনি লেখা শুরু করেছেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা মুস্তাফিজ। পাঠকদের উদ্দেশ্যে তার সেই লেখনি তুলে ধরা হলো হুবহু:-
মাসুদ রানা বনাম বাস্তবতা-২
আমি বিআই-৩২ বা বেসিক ইন্টেলিজেন্স্ কোর্স সিরিয়াল ৩২ করেছিলাম ১৯৯৮ সালে; প্রশিক্ষনের শেষ দিকে আমাদের প্রশিক্ষনের অংশ হিসাবে গোয়েন্দা সম্পৃক্ত বেশ কিছু সংস্হায় আমরা পরিদর্শনে যাই। এর মধ্যে আমার সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং লেগেছিল এনএসআই প্রশিক্ষন একাডেমী পরিদর্শন। একাডেমীর কমান্ডেন্ট ছিলেন গভীর গোয়েন্দা অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ক্যাপ্টেন আমিন (অবসরপ্রাপ্ত)। স্যারের বুদ্ধিদীপ্ত জ্ঞানগর্ভ ব্রিফিং শুনে আমরা একাধারে মন্ত্রমুগ্ধ এবং অনুপ্রানীত হয়েছিলাম। স্যারের ব্রিফিং চলাকালে আমি বাংলাদেশে বিদেশী গুপ্তচরদের কার্যক্রম বা বিদেশে আমাদের কার্যক্রম নিয়ে অনেক প্রশ্ন করি; স্যার অতি আগ্রহের সাথে আমাদের জ্ঞানপিপাসা মেটান।স্যারের লেকচারার সময় জানান এনএসআই এর পুরোনো বিল্ডিংটা যখন ভেংগে নতুন বিল্ডিং করা হয় তখন এর প্রায় প্রতিটি রুমেই ইলেক্ট্রক প্লাগ পয়েন্টের ভেতর হাউজিং করা লিসেনিং ডিভাইস পাওয়া গিয়েছিল! আমাদের এক অফিসার প্রশ্ন করেছিল স্যার কারা এই ডিভাইস লাগিয়েছিল? স্যারের জবাব ডিভাইস গুলোর ম্যানুফ্যাক্চার এবং প্যাটার্ন দেখে নিশ্চিত ভাবে বলা যায় এগুলো ভারতীয় হবার সম্ভাবনাই বেশী।
ব্রিফিং শেষে চাচক্র চলাকালীন স্যার আমাকে ডেকে নিয়ে অনেক কথা বললেন; এমনকি ভবিষ্যতে আমাকে এনএসআইতে নিয়ে আসবেন বলে জানান। এর মধ্যে তিনি আমাকে একটি ৯-১০ পাতার একটি ডকুমেন্ট দিয়ে এটা মনোযোগ সহকারে পড়তে বললেন।আমরা এনএসআই প্রশিক্ষন একাডেমীর পরিদর্শন শেষে যাই পুলিশের ডিবির দপ্তরে। সেখানে আমাদের পুলিশের ব্যাবহারিত ফিংগারপ্রিন্ট এর ব্যাবহার থেকে শুরু করে হত্যা সহ অন্যান্য অপরাধের তদন্ত কার্যক্রম এবং প্রমান সংগ্রহ এবং এর পরবর্তি কার্যক্রমের উপর বিস্তারিত ব্রিফিং দেন এজন সিনিয়ার এএসপি। তবে আমার মন পড়ে ছিল আমিন স্যারের দেয়া সেই ডকুমেন্টের উপর।
সেইদিনের সব প্রোগ্রাম শেষে বাসায় গিয়ে আমিন স্যারের দেয়া ডকুমেন্টটা পর পর দুইবার পরলাম। সেটা ছিল ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্হা রিসার্চ এন্ড এ্যানালাইসিস উইং (র) এর এজেন্টদের প্রশিক্ষনের বিস্তারিত বর্ননা। যদিও ১৯৬৮ সালে “র” এর প্রতিষ্ঠা কালে সরকারী বিভিন্ন প্রতিরক্ষা এবং আইনশৃংখলা বাহিনী থেকে এজেন্টদের রিক্রুট করা হয়েছিল তবে এই ডকুমেন্টে ছিল ফ্রেশ রিক্রুটদের প্রশিক্ষন প্রনালী। সেই ডকুমেন্টে আমার কাছে সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং লেগেছিল তাদের প্রশিক্ষনের শেষ অধ্যায়টি। “র” এর নতুন রিক্রুটদের আনুস্ঠানিক সকল প্রশিজ্ক্ষন শেষে তাদের একটি সীমান্তবর্তী দেশে বাস্তবিক অনুপ্রবেশ করতে হয়। আমার মতে এটা একজন নতুন গোয়েন্দা সদস্যের জন্য অত্যন্ত ঝাঁকিপূর্ণ প্রশিক্ষন। তবে এটা সফলভাবে বা অসফল ভাবে সম্পন্ন করতে পারলেই একজন স্পাই চাকুরীর শুরুতেই একজন সিজনড এজেন্ট হয়ে উঠবে বলে আমি বিশ্বাস করি। নিশন্দেহে এই প্রশিক্ষন প্রনালীর উদ্ভাবক আর এন কাও(“র” এর প্রতিষ্ঠাতা প্রধান) যিনি সাউথ এশিয়া অন্চলে ভারতের পক্ষে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে সকলের শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন। তবে তার বিরুদ্ধেও ইন্দিরা গান্ধির পক্ষে তার বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষের ওপর গোয়েন্দা নজরদারী করার অপবাদ রয়েছে।
এর পর আমার বিআই কোর্স শেষ পোস্টিং হল এএসইউএতে (আর্মি সিকিউরিটা ইউনিট)। এএসইউ থেকে আমাকে বেশ কিছুদিন ঢাকায় কাজ করার পর আমাকে বান্দরবন সেনানিবাসের অধিনায়ক শাখা এএসইউ হিসাবে পোস্টিং দেয়া হল। আমি সেখানকার দায়িত্ব বুঝে নিচ্ছিলাম। আনুমানিক এক সপ্তাহ পরে আমি জানতে পারলাম সেখানকার ৭ ইস্ট বেংগলের একটি সীমান্ত পোস্টের পাস দিয়ে গভীর রাতে এক ভারতীয় পাগল বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ৭ ইস্ট বেংগল তাদের প্রাথমিক জিজ্ঞেসাবাদের পর তাকে পাগল সাব্যস্ত করে স্হানীয় পুলিশের কাছে হ্যান্ডওভার করেছে। সেই ক্যাম্পে আমার কোন এএসইউ সদস্য না থাকায় আমি সাথে সাথে সংবাদটি পাইনি। সকালে প্রঁথমে অফিসে এসে ৭ ইস্ট বেংগলের এ্যাডজুটেন্টকে ফোন করি সে তখন ঘটনাটি আমাকে জানায়।
আমি সাথে সাথে থানায় যাই, তখনও ওসি সাহেব অফিসে আসেননি। আমি তখন সেই কথিত পাগলের সাথে কথা বলি। তার সাথে পরনের কাপড়চোপড় ছাড়া কিছুই ছিল না। প্রথম দর্শনে তাকে আমার সাধারন মানুষ মনে হল, বয়স তিরিশের কোঠায়, ক্লিন শেভড, হাতের পায়ের নখ কাটা; কোন ভাবেই তাকে আমার পাগল বলে মনে হল না, তার দৃস্টি স্বচ্ছ স্বাভাবিক। তার সাথে কথা বলার চেস্টা করলাম সে কথা না বোঝার ভান করল, তাকে বাংলা হিন্দি এবং ইংরাজী ভাষায় জিজ্ঞাসাবাদ করলাম, সে কিছুই বোঝেনা এমন ভাব। আমি নিশ্চিত এই লোক পাগল নয়। আমি এ বিষয়ে বিস্তারিত আমার সদর দপ্তরে জানিয়ে সেই ভারতীয় নাগরিককে পূনরায় আমার বা স্হানীয় ডিজিএফআই সহ যৌথ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য অনুরোধ করি। এই বিষয়ে আমার উৎসাহ দেখে আমার ক্লার্ক আমাকে জানালো
-স্যার গত বছরও কিন্তু এমন ভারতীয় এক নাগরিক ধরা পরেছিল! আমার হার্ট বিট সাথে সাথে বেড়ে গেল!
-কবে? এখনই সেই রিপোর্ট বের কর!
কয়েক ঘন্টা ধরে খুঁজে পুরোনো সেই রিপোর্ট বের করলাম। শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল গত ৫ বছরে এটা সহ তিন জন এমন ভারতীয় নাগরিক বান্দরবন সীমান্ত থেকে ধরা পরেছিল! তার মানে এই সময়ের মধ্যে আরও ভারতীয় নাগরিক বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারে যারা হয়ত সীমন্তে মোতায়ন বাহিনীর কাছে ধরা পরেনি!
এবার আমার তদন্তের পরিধি বেড়ে গেল। খোঁজ নিলাম শেষ পর্যন্ত আগের দুই অনুপ্রবেশকারী ভারতীয় নাগরিকদের শেষ পর্যন্ত কি হয়েছিল? আগের দুইজনও ছিল অপ্রকৃতস্হ/পাগল এবং তারা ধরা পরার কিছুদিন পর একটি চট্টগ্রাম বেজড ভারতীয় এনজিও তাদের ডিসপ্লেস্ড পার্সন হিসাবে আইনি প্রকৃয়ায় ছাড়িয়ে নিয়ে গেছে। সমস্ত তথ্য প্রমানাদী বিশ্লেষনে আমি তখন নিশ্চিত এই কথিত অনুপ্রবেশকারী ভারতীয় পাগলরা সম্ভাবত ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্হার শিক্ষানবীস সদস্য। এই সমস্ত তথ্য উপাত্ত এবং এর সাথে ক্যাপ্টেন আমিন স্যারের দেয়া ডকুমেন্টের সাথে লিংকআপ করে আমি আমার সদরদপ্তরে চিঠি লিখি এবং এই ঘটনার ফলোআপ করার জন্য সুপারিশ করি। যাহোক এর কিছুদিন পর আমাকে আধিনায়ক সিলেট শাখা এএসইউ হিসাবে বদলী করা হল তাই এর পর কি হয়েছিল সে বিষয়ে আমি আর জানতে পারিনি।
এবার আসি বর্তমানে; আপনারা মেইনস্ট্রীম সংবাদ মাধ্যমে না হলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখেছেন যমুনা ব্রীজ এবং রুপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের আসেপাশে নিয়মিত ব্যাবধানে ভারতীয় নাগরিক ধরা পরছে। এমনকি গত ২১ নভেম্বর ২০২১ শে রুপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে সুজ্জা নমক এক ভারতীয় নারী তার এদেশীয় সহযোগী সহ ঐ স্হাপনার গুরুত্বপূর্ণ ও গোপন নথি সহ ধরা পরে। আর এক তদন্ত উঠে আসে ভারতীয় গোয়েন্দাদের পুরোনো এবং কার্যকরি পন্থা হানিট্রাপের ব্যাবহার। রুপপুর পারমানবিক কেন্দ্রের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা কর্মচারীদের সাথে বিভিন্ন নারীদের সাথে ঘনিস্ঠ সম্পর্ক তৈরী করে তাদের ছবি এবং ভিডিও গ্রহন করে তাদের ব্ল্যাকমেইল করে ভারতীয় গোয়েন্দারা ঐসব নথি সংগ্রহ করে।
অপরদিকে আমার জানামতে এখন পর্যন্ত ১১+ ভারতীয় নাগরিক পদ্মা সেতু এলাকায় ধরা পড়েছে, এদের কারো কাছেই পাসপোর্ট বা অন্যকোন সনাক্তকরার মত কাগজপত্র ছিলনা এবং প্রায় সবাই পাগল/অপ্রকৃতস্হ সাজার চেস্টা করেছিল। এদের সবাইকে বান্দরবনে ধৃত ভারতীয় নাগরিকদের মত বাংলাদেশে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসাবে মামলা হয়েছে এবং আমি নিশ্চিত বর্তমান প্রেক্ষপট বিবেচনায় তার আরও দ্রুত ছাড়া পেয়ে ভারতে ফেরত যাবে। আমি নিশ্চিত রুপপুর পারমানবিক কেন্দ্রে গ্রেফতারকৃত ভারতীয় নাগরিকরা “র” এর সিজনড এজেন্ট আর পদ্ম সেতুতে ধরা পড়া ভারতীয় নাগরিকগন শিক্ষানবীস গোয়েন্দা এজেন্ট। আগে তারা এসব শিক্ষানবীসদের বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অন্চল দিয়ে অনুপ্রবেশ করাত আর এখন তার দেশের কেপিআই(দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্হাপনা) গুলো তাদের শিক্ষানবীসদের প্রশিক্ষনে ব্যাবহার করার সাহস পায়।
আচ্ছা আমার জানতে মনচায় আমাদের গোয়েন্দারা এ বিষয়টি নিয়ে কি ভাবছে? সেই গ্রেফতারকৃত ভারতীয় নারী সুজ্জা সহ অন্যান্যদের এখন কি পরিস্হিতিত রাখা হয়েছে? সাধারনত কোন দেশের স্পাই অন্য কোন দেশে ধরা পড়লে তাদের কঠোর শাস্তি অথবা তাদের ছেড়ে দেবার বিনিময়ে সেই দেশ থেকে অনেক সুযোগসুবিধা আদায় করে নেয়। আমাদের মাসুদ রানারা কি এই সুযোগের সহব্যবহার করছে? অথবা ভারতীয় সেই গোয়েন্দা শিক্ষানবীসদের বিষয়ে কোন ব্যাবস্হা নিয়েছে?
আধুনিক রাস্ট্র ব্যাবস্হায় কোন দেশ কোন দেশের স্হায়ী বন্ধু বা শত্রু নয়। দেশটির সাথে সম্পর্ক হবে দেয়া নেয়ার, যে কোন চুক্তির আগে সেই দেশের গোয়েন্দা সংস্হাকে দায়ীত্ব দেয়া হয় সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আরও অধিক তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে সেই দেশের দূর্বল এবং সবল দিকগুলো বিবেচনা করতে। সেই চুক্তির আগে যেন সব হিসেব নিকেশ করে দেশের স্বার্থ রক্ষায় সরকার সঠিক সিদ্ধান্তে পৌছাতে পারে। কিন্তু আমরা বাস্তবে কি দেখি, আমরা ভারতকে করিডোর দেই কিন্তু ভারত আমাদের নেপালে যাবার করিডোর দেয়না। আমরা শিপমেন্ট চার্জ সুপারিশ ১০,০০০/- হলে পরে সেটা ৫০০/- টাকা হয়ে যায়। এমন হয়ত অসংখ্য উদাহরণ দেয়া যাবে! গোয়েন্দা সংস্হাগুলি প্রধানমন্ত্রীর উপদেস্টা হিসাবে কাজ করার কথা কিন্তু তারা শুধুই আজ্ঞাবহ। আওয়ামীলীগ সরকার(অনেক ক্ষেত্রেই ভারতের সুপারিসে) বেছে বেছে অসৎ ব্যাক্তিগুলোকে রাস্ট্রিয় এসব গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছে যেন তার দেশের কথা চিন্তা না করে তার পদের কথাই ভাবে।
সত্য সমাগত মিথ্যা বিতাড়িত।
চলবে……….
প্রসঙ্গত, মো. মুস্তাফিজুর রহমান বাংলাদেশের সাবেক একজন চৌকশ সেনা কর্মকর্তা। ২০১২ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তা হিসেবে। এরপর পাড়ি জমান বিদেশে। বর্তমানে তিনি প্রবাস জীবনেই রয়েছেন। আর সেখানে থেকেই নানা ধরনের লেখালেখি করে চলছেন। স্যোশাল মিডিয়ায় তার লেখনি বেশ জনপ্রিয় হয়ে আছে।