বাংলাদেশ এবং ভারতের নতুন দ্বার উন্মোচন হতে চলেছে আবারো। চার দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে সোমবার ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি পৌঁছেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সফরের দ্বিতীয় দিনে মঙ্গলবার (৬ সেপ্টেম্বর) তিনি বাণিজ্য চুক্তি ছাড়াও বেশ কয়েকটি সমঝোতা স্মারক সই করবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
তবে চুক্তি ও সমঝোতার বিষয়ে নির্ধারিত এজেন্ডা যাই হোক না কেন, আলোচনার অনেক বিষয় থাকবে। দুই প্রধানমন্ত্রীর একান্ত বৈঠকে আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতি ও নিরাপত্তা, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন এবং জ্বালানি ইস্যু প্রধান আলোচ্য বিষয় হতে পারে বলে কূটনৈতিক সূত্রের ধারণা। এই তিনটি বিষয়ে দুই প্রধানমন্ত্রী একে অপরের কাছ থেকে আশ্বাস পেতে পারেন।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আজকের বৈঠকটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে সূত্র মনে করছে। ২০১৯ সালের অক্টোবরে দিল্লি সফরের পর, শেখ হাসিনা এবং নরেন্দ্র মোদি গত সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের অধিবেশনে যান এবং সেখানে একটি ব্যক্তিগত বৈঠক করেন। সেই বৈঠকের পর এক বছর কেটে গেছে। পরে মুজিববর্ষের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে নরেন্দ্র মোদি ঢাকায় এলেও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক বিষয়গুলো সামনে আসেনি। জাতিসংঘের অধিবেশনে নরেন্দ্র মোদির অংশগ্রহণ এখনো নিশ্চিত হয়নি। তার পরিবর্তে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রে যেতে পারেন। তাই এই সফর ছাড়া ভবিষ্যতে দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের কোনো সম্ভাবনা নেই বলেই মনে করা হচ্ছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আজকের বৈঠকে জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা শেষ করতে চান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব জ্বালানি সংকটে পড়েছে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশেও। কিছুদিন আগে বাংলাদেশ সরকার জ্বালানি তেলের দাম বাড়াতে বাধ্য হয়। শতভাগ বিদ্যুতায়নের পরও জ্বালানি সংকটের কারণে আওয়ামী লীগ সরকারকে লোডশেডিংয়ের মতো সিদ্ধান্তে যেতে হচ্ছে। তাই এই সংকট মোকাবেলায় বাংলাদেশ ভারতের সাহায্য চাইতে পারে।
প্রাণের ভয়ে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আর কতদিন আকৃষ্ট করবে বাংলাদেশ? গৃহহীন রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরেও নানা সংকট সৃষ্টির চেষ্টা করছে। এদিকে গত এক মাসে অন্তত তিনবার মিয়ানমারের মর্টার শেল ও গোলা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। বিষয়টি নিয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ। নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে আজকের বৈঠকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে ভারতের বলিষ্ঠ ভূমিকা প্রত্যাশা করবে বাংলাদেশ।
প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের সাম্প্রতিক ভূমিকা নিয়ে ভারত সতর্ক। গত কয়েক বছরে সীমান্তে দুই দেশের মধ্যে বেশ কয়েকবার সংঘর্ষ হয়েছে। তাই ভারত আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক ইস্যুতে বাংলাদেশের সহযোগিতা চাইতে পারে। বাংলাদেশে যৌথ সামরিক কারখানা গড়তে চায় দেশটি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরে দিল্লি বিষয়টি নিশ্চিত করতে চায়। আজ দুই নেতার একান্ত বৈঠকেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হতে পারে।
ভারত একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে যৌথ সামরিক কারখানা স্থাপন করতে চায়। সামরিক সহযোগিতা ও সরঞ্জাম সহায়তা ছাড়াও বাংলাদেশের কারখানায় তৈরি সামরিক সরঞ্জাম ও অস্ত্র এখান থেকে ভারতে রপ্তানি করা হবে। এর মাধ্যমে সামরিক সহযোগিতার বাইরে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতা কমাতে চায় দিল্লি।
দিল্লির একজন সিনিয়র সাংবাদিক এবং সর্বভারতীয় প্রেস ক্লাবের প্রাক্তন সভাপতি গৌতম লাহিড়ী বলেছেন, ভারতের প্রতিরক্ষা সচিব এবং বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর একজন সিনিয়র অফিসারের নেতৃত্বে আগস্টে চতুর্থ ভারত-বাংলাদেশ বার্ষিক প্রতিরক্ষা সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এ সময় একটি আপগ্রেডেড দ্বিপাক্ষিক প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তির গ্রাউন্ড ওয়ার্ক চূড়ান্ত করা হয়। এই বৈঠকে যৌথ প্রতিরক্ষা উৎপাদনের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়। সে সময় বলা হয়েছিল, এই প্রথম ভারত ও বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা হার্ডওয়্যার ও সরঞ্জাম উৎপাদনে হাত মেলাতে পারবে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচি দিল্লিতে গণমাধ্যমকর্মীদের বলেছেন, “সম্প্রতি দুই দেশের (বাংলাদেশ ও ভারত) মধ্যে এমনকি সর্বোচ্চ পর্যায়েও বেশ ঘন ঘন বৈঠক হয়েছে।” তারপরও আমরা বিশ্বাস করি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফর দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরও মজবুত করবে। কারণ, এ সম্পর্ক ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধন এবং পারস্পরিক আস্থার ভিত্তিতে নির্মিত।
এ দিকে এই সফর নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা শুরু হয়েছে আন্তর্জাতিক মহলেও। দুই দেশের অনেক বিশেষজ্ঞরাও বলছেন অনেক আশার কথা। বিশেষ করে সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে আলাপ-আলোচনা হলে এতদিনের সম্পর্ক আরেকটু নিবিড় হবে। এতে অমীংমাসিত বিষয়গুলো হয়তো সমাধানের দিকে যাবে। দ্বিতীয়ত, নতুন সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা হবে। বর্তমানে বৈশ্বিক বা আঞ্চলিক পরিবেশ বদলে যাচ্ছে। সেই প্রেক্ষাপটের আলোকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই সফরে নতুন কিছু চিন্তাভাবনা আসবে।