ডলি সায়ন্তনী বাংলাদেশ এর সংগীতাঙ্গনে একটি বড় নাম। দীর্ঘ দিন ধরেই তিনি দেশ এর মানুষকে তার গান দিয়ে মাতিয়ে রেখেছেন। সম্প্রতি তার অতীত নিয়ে একটি বিষয় নতুন করে আবার শুরু হয়েছে অনেক লেখা লেখি। দেশের একটি অনলাইন প্রত্রিকার প্রতিবেদক কামরুল হাসান লিখেছেন ডলি সায়ন্তনীর ঘটানো একটি সমালোচিত ঘটনার কথা।
তিনি লিখেছেন , সপ্তাহান্তে বৃহস্পতিবার পড়লে বাড়তি সুবিধা আছে। পরের দিন শুক্রবার অফিসের কাজ শুরু হয় দেরিতে। একদিনের ছুটি দেড় দিন বেশি। ২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে মনের মধ্যে সেই সুখ গুনছি, আমার সপ্তাহান্ত ছিল বৃহস্পতিবার। রবীন্দ্রনাথ যিনি বলেছিলেন, ‘মূর্তির মতো দেব- হাসিমুখে’। বেশিরভাগ ছুটি আমি সেই অভ্যন্তরীণ হাসির সাথে ভাগ্যবান ছিলাম না। দেখা গেল, বড় বড় সব ঘটনাই বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে ঘটছে। আর ঘটনা ঘটলেই অফিস থেকে ফোন…দৌড় লাগাও, কিসের ছুটি! পত্রিকা অফিসের ক্রাইম রিপোর্টাররা হলো ‘ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো’, অতএব না করে রক্ষে নেই।
ডিসেম্বর ৭, ২০০০ ছিল একটি বৃহস্পতিবার, একটি মধুর ছুটির দি। বিকেলে বেইলি রোডে মহিলা সমিতির মঞ্চে নাটক দেখতে টিকিট কিনে বসে আছি। হঠাৎ অফিস থেকে চিফ রিপোর্টারের ফোন। ফোন তোলার আগে মনে হলো কোথাও কোনো সমস্যা হয়েছে। আমি যা ভেবেছিলাম. চিফ রিপোর্টার বলেন, বাড্ডার দিকে ছুটে যান, গায়িকা ডলি সায়ন্তনীকে লোকজন ঘিরে রেখেছে, তার গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে উত্তেজিত জনতা। ডলি সায়ন্তনী তখন খুবই জনপ্রিয়। ‘রং চাটা জিন্স’ ক্যাম্পাসের তরুণদের মুখের কথা। কী রকম নাটক দেখলাম, টিকিটটা রাস্তায় ফেলে দিয়ে বাড্ডায় ছুটলাম।
মৌচাক থেকে মালিবাগ রেলগেটের দিকে আসতেই মনে হলো রাস্তায় যানজট কম। ডিআইটি রোড ধরে রামপুরার দিকে এগোলে যানবাহনের সংখ্যা কমতে থাকে। রামপুরা ব্রিজ, উত্তরে বাড্ডার দিকের রাস্তাটা একেবারেই ফাঁকা। ব্রিজের পেছনে পুলিশ ব্যারিকেড, কাউকে যেতে দিচ্ছে না। ক্রাইম রিপোর্টারদের সুবিধা আছে। পুলিশ মোটরসাইকেল থামিয়ে পরিচয় দিয়ে রাস্তা ছেড়ে দেয়।
ডিআইটি রোডের বাড্ডা এলাকায় ইউলুপ যেখান থেকে একটু এগিয়ে বাম পাশে আলাতুন নেসা স্কুল। স্কুলটা রাস্তার কাছে না হলেও একটু ভিতরে। স্কুলের আশেপাশেই দৃশ্যটা মনে হয়। রাস্তায় হাজার হাজার ইট। বাড্ডা থেকে গুলশান ১ নম্বর মোড়ে অবস্থানরত পুলিশের একটি দল জনতাকে লক্ষ্য করে টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে এবং লোকজন পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়ে।
আলাতুন নেছা স্কুলে ঢুকে দেখেন একটি প্রাইভেটকার পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। গাড়িতে আগুন লেগে ভবনের বেশ খানিকটা ক্ষতি হয়েছে। আমি গিয়ে দেখি আগুন নিভে গেছে কিন্তু ধোঁয়া বের হচ্ছে। কি হয়েছে তা বের করার চেষ্টা করছি। কিন্তু মানুষ এতটাই উচ্ছ্বসিত যে কেউ সঠিকভাবে বলতে পারে না। অবশেষে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকে পেলাম। তিনি জনগণকে বোঝানো এবং তাদের শান্ত করার চেষ্টা করছেন।
তার কাছে ঘটনা জানতে চাইলে তিনি পুরো ঘটনা খুলে বলেন। এবার তা আপনাদের বলি। ডলি সায়ন্তনী তখন তার প্রথম স্বামীর থেকে আলাদা হয়ে যায়। রবি চৌধুরীর সঙ্গে সম্পর্ক চলছে। আগের ঘরে একটা মেয়ে আছে, নাম কথা।
তাকে নিয়ে ডলি সায়ন্তনী স্কুল থেকে রামপুরার বাসায় ফিরছিলেন। গাড়িটি চালাচ্ছিলেন তিনি নিজেই। বাসায় আসার পথে মধ্যবাড্ডা এলাকায় তাঁর গাড়িটি একটি শিশুকে চাপা দেয়। শিশুটি সামনের চাকায় লেগে গাড়ির নিচে পড়ে যায়, এরপর পেছনের চাকাটি তার গায়ের ওপর উঠে পড়ে। এতে ঘটনাস্থলেই শিশুটি মারা যায়। শিশুটির নাম রকি, সে আলাতুন নেসা স্কুলের তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ত। তার বাবা খলিলুর রহমান ছিলেন সৌদিপ্রবাসী। দুই ভাইয়ের মধ্যে রকি বড়, থাকত দক্ষিণ বাড্ডায়।
বাড্ডা সড়ক এমনিতেই জমজমাট। তারা শিশুটিকে পড়ে থাকতে দেখে গাড়িটি আটক করে। লোকজন তাকে নামতে বললেও সে গাড়ি থেকে নামল না। এরপর লোকজন তাকে গাড়ি থেকে টেনে নিয়ে যায়। অবস্থা বেগতিক দেখে ডলি তার বন্ধু রবি চৌধুরীকে ফোন করেন। একটু পরেই ঘটনাস্থলে আসে রবি। তিনি আসতেই শিশুটি কিছু হয়নি বলে চিৎকার করতে থাকে। এটি মানুষকে আরও বিচলিত করে তোলে। তারা ডলিকে আটক করে এবং রবিকে মারধর করে। পথচারীরা শিশুটিকে হাসপাতালে পাঠিয়ে আলাতুন নেছা স্কুলের ভেতরে ডলির গাড়ি নিয়ে যায়। বাড্ডার প্রধান সড়ক অবরোধ করে জনতা। যথারীতি পুলিশের কাছে খবর যায়।
কামরুল ইসলাম বাড্ডা থানার ওসি ছিলেন। ঘটনার তদন্তে পুলিশের একটি দল পাঠিয়েছেন তিনি। তারা এসে ডলির পক্ষের লোকজনকে মারধর শুরু করে। এতে জনতা ক্ষিপ্ত হয়ে পুলিশের ওপর হামলা চালায়। পুলিশ কোনোমতে ডলি ও রবি চৌধুরীকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর খবর আসে শিশুটির মৃত্যু হয়েছে। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে জনতা আবার উত্তেজিত হয়ে ওঠে। শুরু হয় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ। তখনই ডলির গাড়িতে আগুন লাগে। প্রায় দুই ঘণ্টা সংঘর্ষের পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।
রাত ১০টার দিকে বাড্ডা থানায় গিয়ে দেখি ডলি ও রবি চৌধুরীকে ওসির কক্ষে আটকে রাখা হয়েছে। সেলিম আশরাফ নামে একজন সঙ্গীত পরিচালকও ছিলেন সেখানে। ডলি গাড়ির কাগজপত্র ও লাইসেন্স দেখতে চাইলে সে পুলিশকে জানায়, গাড়ির সব কাগজপত্র পুড়ে গেছে। রাত ১০টার পর জনবিষেকের যুবক ডলিকে নিয়ে বাড্ডা থানায় আসেন। তারা সব সাংবাদিককে থানা থেকে জোর করে বের করে দেয়। কিছুক্ষণ পর তিন-চারজন যুবক আব্দুল আউয়াল নামে এক ব্যক্তিকে নিয়ে এসে জানায়, সে নিহত ছেলের মামা। তিনি কোনো অভিযোগ করতে চান না।
পরদিন শুক্রবার সকালে আলাতুন নেছা স্কুল মাঠে রকির জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় হাজার হাজার মানুষ অংশ নেন। জানাজা শেষে জনতা আবারও সড়ক অবরোধ করে। খবর পেয়ে পুলিশ কর্মকর্তারাও আসেন। তারা এসে বলল ডলিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। রকির চাচা আব্দুল আউয়াল বাদী হয়ে দণ্ডবিধির ৩০৪ ধারায় এ মামলা করেন। নুরুজ্জামান নামে এক কনস্টেবল মামলার তদন্তকারী ছিলেন। তিনি সকালে ডলিকে আদালতে পাঠান। দুপুরের দিকে খবর আসে ডলি জামিনে বেরিয়েছে।
রকির দাফন শেষে লোকজন যথারীতি নিজ নিজ কাজে বাড়ি চলে যায়। সময় যায়. কয়েকদিন পর মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে ডলি সায়ন্তনীকে ছেড়ে দেয় পুলিশ। তিনি মামলা থেকে বেঁচে যান।
এ সময় আমরা শুনছিলাম, বিষয়টি মিমাংসা করার জন্য ভুক্তভুগি পরিবারকে মোটা অঙ্কের প্রলোভন দেওয়া হচ্ছে। দুদিন পর আমি রকির বাড়িতে ফলোআপের জন্য গেলে তার মা আমাকে বলে, আমি টাকার জন্য তার ছেলের খুনিকে ক্ষমা করব না।
খুলনার আহসান আহমেদ রোডের দুই শিশু তনু ও তুটন ওই সময় এ ঘটনার বিচার চেয়ে সংবাদপত্রে বিবৃতি পাঠিয়ে বলেন, এভাবে সড়কে আর কোনো শিশুর মৃত্যু যেন না হয়।
এরপর অনেক পানি বয়ে যায়, সড়কে প্রাণ হারায় আরো অনেক শিশু। এখন প্রায়ই রাস্তায় কেউ মারা যাচ্ছে। সেদিনের দুই সন্তানের আরতি এই ক্ষয়িষ্ণু সমাজের মানুষ শুনবে এবং গ্রহণ করবে- তখন কেউ ছিল না, এখনও কেউ নেই।
ঘটনার ২২ বছর পেরিয়ে গেছে হয়তো এই ঘটনার কথা ডলি সায়ন্তনী নিজেও গেছেন ভুলে। তবে এ ধরণের ঘটনা এখনো হরহামেশাই ঘটে যাচ্ছে সারা দেশে।