গত দুই বছরে ডলার বাংলাদেশের অর্থনীতিকে অনেকটাই ঘুরিয়ে দিয়েছে। উচ্চ মূল্যের পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহের ঘাটতি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলেছে। তবে গতি হারাতে শুরু করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা। উল্টো শক্তিশালী হচ্ছে বাংলাদেশি মুদ্রা।
কয়েকদিন আগে ব্যাংকগুলো ১২৪ টাকা পর্যন্ত রেমিটেন্স ডলার কিনেছে। তারা এখন প্রতি ডলার ১১৪ টাকা দরে কিনছেন। বুধবার আমদানি বিল নিষ্পত্তিতে ডলারের দাম ১১৮ টাকা থেকে ১১৯ টাকায় নেওয়া হয়েছে, যা দুই সপ্তাহ আগে ছিল ১২২ টাকা থেকে ১২৪ টাকা।
খোলাবাজার বা কার্ব মার্কেটেও ডলারের দর বড় ধরনের পতন হয়েছে। বুধবার এই বাজারে প্রতি ডলার ১১৮ টাকা ৪০ পয়সায় বিক্রি হয়েছে। মাসখানেক আগেও তা ছিল ১২৬ থেকে ১২৭ টাকা।
সব মিলিয়ে ডলারের বাজারে অস্বস্তি কমছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ডলারের ‘অস্থিতিশীল’ বাজার ‘স্থিতিশীল’ হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন।
তবে আন্তঃব্যাংক লেনদেনে ডলারের দর এখনও অনেক কম, ১১০ টাকা। অর্থাৎ এক ব্যাংক আরেক ব্যাংক থেকে ১১০ টাকা দরে ডলার কিনছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে বাংলাদেশ ব্যাংক যে ডলার বিক্রি করছে, সোয়াপ কারেন্সির আওতায় টাকা-ডলার অদলবদল করছে সেটাও ১১০ টাকা দরে।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, আমদানি ব্যয় কমিয়ে রপ্তানি আয় ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স বৃদ্ধির ফলে বাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়েছে। যে কারণে ডলারের মূল্য কমতে শুরু করেছে। এই ধারা বজায় থাকলে দুই বছর ধরে চলমান অস্থির ডলারের বাজারে স্বস্তি ফিরে আসবে। সামগ্রিক অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত, দেশের মুদ্রা বিনিময় হার প্রায় এক দশক ধরে স্থিতিশীল অবস্থানে ছিল। এতে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো লাভবান হয়েছে, যা সামগ্রিক অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
যুদ্ধের ধাক্কা আসে যখন করোনা মহামারীর পরে বিশ্ব অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে বিশ্ববাজারে পণ্য ও কাঁচামালের দাম বেড়েছে। ফলে ডলারের বিপরীতে রুপির অবমূল্যায়ন হচ্ছে।
কয়েক মাসের মধ্যেই প্রতি ডলারের দাম ৮৫/৮৬ থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ১০০ টাকার ওপরে। রপ্তানিকারক, আমদানিকারক এবং রেমিট্যান্স প্রেরকদের মতো সেক্টর জুড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক বিনিময় হার বাস্তবায়ন সত্ত্বেও ডলারের বিপরীতে রুপির অবমূল্যায়ন অব্যাহত রয়েছে।
২০২৩ সালের শেষ ত্রৈমাসিকে, দেশের মুদ্রা বাজার বিনিময় হারে অভূতপূর্ব অস্থিতিশীলতার সম্মুখীন হয়েছে। চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচনের পর দেশের মুদ্রাবাজার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। এতে করে সংশ্লিষ্টরা কিছুটা আস্থা ফিরে পান। সামগ্রিক চাহিদা কমে যাওয়ায় অনেক বাণিজ্যিক ব্যাংক এখন আর বেশি দামে ডলার কিনছে না।
অন্যদিকে দাম বাড়বে এই আশায় প্রবাসী বাংলাদেশিসহ যারা ডলার সঞ্চয় করেছিলেন, তারাও টাকার মূল্য বেড়ে যাওয়ায় ওই ডলারগুলো বাজারে ছাড়তে শুরু করেন। এমন বাস্তবতায় দেশে চাহিদার চেয়ে বেশি ডলার আসছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, ‘ডলার সংকট কাটাতে বিভিন্ন সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। সেগুলোরই একটা প্রভাব এখন বাজারে পড়ছে। ব্যাংকগুলোতে ডলারের সরবরাহ বাড়ায় দামও কমছে।’
বিদেশি মুদ্রা লেনদেনকারী ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) চেয়ারম্যান ও সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল করিম বলেন, ‘অনেকেরই ধারণা ছিল ডলারের দাম আরও বাড়বে। তবে আমরা বলেছিলাম দাম বাড়ার কোনও কারণ নেই। তার প্রতিফলন আমরা ইতোমধ্যে দেখতে পাচ্ছি।
আমাদের চাহিদা-সরবরাহের ব্যবধান কমে যাওয়ায় অনানুষ্ঠানিক বাজারে ডলারের দরও কমেছে। আশা করছি আরও কমবে। আমরা বিষয়টি পর্যবেক্ষণে রেখেছি।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও বেসরকারি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, “গত কয়েক মাস ধরে প্রবাসী আয় ক্রমাগত বাড়ছে। রপ্তানি আয়ে ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে। অন্যদিকে আমদানি খরচও কমেছে, ফলে চলতি হিসাব উদ্বৃত্ত হয়ে গেছে, ব্যাংকগুলো এখন এলসি খুলতে আগ্রহ দেখাচ্ছে।