মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান থানায় মুখে গামছা বেঁধে শূন্যে ঝুলিয়ে ১০ জনকে পিটিয়ে অজ্ঞান করার অভিযোগ উঠেছে। ইতোমধ্যে ওসিসহ ৯ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা হয়েছে। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে মুন্সীগঞ্জের পুলিশ সুপারকে এফআইআর হিসেবে গ্রহণ করতে বলেন। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশও দিয়েছেন তিনি। একইসঙ্গে বাদীর জখম বা আহত হওয়ার বিষয়ে সিভিল সার্জনকে প্রতিবেদন দিতে বলেছেন। গত ৩০ এপ্রিল দুপুরে সিরাজদিখান উপজেলার কেয়াইন ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল বারেক কারাগার থেকে বাদী হয়ে মুন্সীগঞ্জ সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ আদালতে নালিশি মামলা করেন।
মামলার আসামিরা হলেন- সিরাজদিখান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মুজাহিদুল ইসলাম, ওসি (তদন্ত) মো. মোক্তার হোসেন, উপপরিদর্শক (এসআই) রতন বৈরাগী, মো. লোকমান হোসেন, মো. মনোয়ার হোসেন, মো. সালাউদ্দিন, সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মো মাইনুল, মো. আল আমিন হাওলাদার ও কনস্টেবল মো. মিজানুর রহমান।
এরপর গত ৫ মে মামলাটি আমলে নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে আদেশ দেন আদালত। আদালতের বেঞ্চ সহকারী মো. হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ওই দিনই (৫ মে) আদালতের আদেশের কপিসহ মামলাটি সেরেস্তার কাছে পাঠিয়েছি।
প্রধান জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক সাইদুর রহমান বলেন, গত ৫ মে আদেশের পর আমি ওই আদেশের অনুলিপি সংশ্লিষ্ট পুলিশ সুপারের কার্যালয় ও পিবিআই কার্যালয়ে পাঠিয়েছি। আদেশের অনুলিপি ৬ মে সিভিল সার্জনের কাছে পাঠানো হয়েছে। মামলার এজাহারে বলা হয়, ২২ এপ্রিল বিকেল ৪টার দিকে বাদীসহ ৫-১৪ নম্বর সাক্ষী মো. ইসরাফিল শেখ, তৌফিক আহমেদ তুষার, ফরহাদ হোসেন, মো. সৈকত হোসেন, আমিনুল ইসলাম, মো. আসাদুজ্জামান, আব্দুল হাকিম, রেজাউল বারি ওরফে রাজু, তায়েব ভূইয়া ও মো. রুবেল আসন্ন সিরাজদিখান উপজেলা পরিষদ নির্বাচন উপলক্ষ্যে তাদের মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী আওলাদ হোসেন মৃধার সমর্থনে ওই এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে সিরাজদিখান উপজেলার কুচিয়ামোড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে আলোচনা করছিলেন। এ সময় আরেক উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী মাইনুল ইসলাম নাহিদের মামা আশ্রাফ আলীর ইন্ধনে এই মামলার আসামি পুলিশের ওই ৯ সদস্যসহ আরও অজ্ঞাতনামা ২০-২৫ জন এসে অতর্কিত লাঠিপেটা শুরু করেন। পরে পুলিশ আব্দুল বারেকসহ ৫-১১ নম্বর সাক্ষীকে জোর করে ভ্যানে তুলে সিরাজদিখান থানায় নিয়ে যান। সেখানে একটি অন্ধকার কক্ষে তাদের আটকে রাখেন।
পরে ওইদিন রাত ৮টার দিকে পুলিশের ৯ সদস্য কাঠের ডাসা, প্লাস্টিকের কালো লাঠি, প্লাস্টিকের দড়ি ও গামছা নিয়ে ওই অন্ধকার কক্ষে প্রবেশ করে একটি চার্জার লাইটের মাধ্যমে আলো জ্বালান। অভিযুক্ত নং-১, সিরাজদিখান থানার ওসি মোজাহিদুল ইসলাম অন্যদের নির্দেশ দেন- “সকল শাল মুখে গামছা বেঁধে ছাদ থেকে ঝুলিয়ে রাখ।” ঝুলা।’ এরপর পুলিশ সদস্যরা মামলার বাদীসহ সবাইকে মুখে গামছা বাঁধেন এবং দুই হাত একত্রিত করে বেঁধে ওপরের দিকে শূন্যে ঝুলিয়ে রাখেন। এ সময় সিরাজদিখান থানার ওসি মোজাহিদুল ইসলাম একটি কাঠের ডাসা দিয়ে মামলার বাদীর পায়ের তালুতে মারতে থাকেন। অন্য পুলিশ সদস্যরা ৫-১৪ নম্বর সাক্ষীকে পায়ের তালুতে এবং কোমরের নিচ থেকে কনুই পর্যন্ত আঘাত করে সবাইকে অজ্ঞান করে ফেলেন। এ সময় মামলার বাদী অজ্ঞান হয়ে যান।
পরে জ্ঞান ফিরলে তিনি দেখেন, পুলিশের অমানবিক ও নির্মম মারধরে তার বাম পায়ের হাঁটুর নিচ থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে এবং অন্যরা মেঝেতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। এ সময় আসামি ৮ নং এএসআই মোঃ মইনুল সবার নাকে-মুখে পানি ঢেলে চেতনা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। পরে সবাইকে চিকিৎসার জন্য সিরাজদিখানের ইশাপুরা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে পুলিশ মামলাসহ ৫ দিনের রিমান্ড চেয়ে বাদীসহ ৫-১৪ নম্বর সাক্ষীকে আদালতে পাঠায়। পুলিশের নির্যাতনে সিরাজদিখান উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক ডা. আঞ্জুমান আরা বলেন, যতদূর মনে পড়ে আমার হাসপাতালে ওই দিন রাতে ১০ থেকে ১১ জন চিকিৎসা নেন। কিন্তু তাদের শরীরে কী ধরনের আঘাত ছিল তা এখন মনে নেই। অভিযুক্ত সিরাজদিখান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোঃ মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, এ ঘটনায় মামলা হয়েছে কি না তা জানি না। মামলার বাদীসহ সাক্ষীদের নির্যাতনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি অস্বীকার করেন।
মুন্সীগঞ্জ পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পুলিশ সুপার মুহাম্মদ আনোয়ারুল হক বলেন, আদালতের নির্দেশনা পেয়েছি। এ বিষয়ে তদন্ত করা হবে। তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দেব। জানা যায়, গত ২৩ এপ্রিল সিরাজদিখান থানায় বাদী হয়ে মামলা করে পুলিশ। এতে ৩৪ জনের নাম ও অজ্ঞাত ৫০-৬০ জনকে আসামি করা হয়েছে। পরে পুলিশ আব্দুল বারেকসহ ১৩ জনকে আটক করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠায়। পুলিশের মামলার এজাহারে বলা হয়, গত ২২ এপ্রিল সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে ওই এলাকার কয়িন ইউনিয়নের আশরাফ চেয়ারম্যান গ্রুপ ও সাবেক চেয়ারম্যান বারেক গ্রুপ কুচিয়ামোড়া এলাকায় দাঙ্গা-হাঙ্গামার উদ্দেশ্যে একত্রিত হয়ে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।