Thursday , May 16 2024
Breaking News
Home / Exclusive / বৃদ্ধাশ্রমের মধ্যেই ‘টর্চার সেল’ বানিয়েছে কথিত মানবতার ফেরিওয়ালা মিল্টন সমাদ্দার, বেরিয়ে এলো চাঞ্চল্যকর সব তথ্য

বৃদ্ধাশ্রমের মধ্যেই ‘টর্চার সেল’ বানিয়েছে কথিত মানবতার ফেরিওয়ালা মিল্টন সমাদ্দার, বেরিয়ে এলো চাঞ্চল্যকর সব তথ্য

মিল্টন সমাদ্দার জনগণের অনুদানে নির্মিত নার্সিং হোমের ভেতরে তিন কক্ষের টর্চার সেল নির্মাণ করেন। ‘চাইল্ড এন্ড ওল্ড এজ কেয়ার’ নামের প্রতিষ্ঠানের ভবনের ওই টর্চার সেলে মানুষকে ধরে নিয়ে পেটানো হয় নির্মমভাবে। টর্চার সেলে মানুষ মারতে বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্র রয়েছে। কালবেলার তদন্তে ওই কক্ষে নির্যাতনের একাধিক ঘটনা বেরিয়ে আসে। সেখানে কীভাবে নির্যাতন চালানো হয় তা গণমাধ্যমের কাছে বর্ণনা করেছেন নির্যাতনের শিকার বেশ কয়েকজন।

সর্বশেষ গত ঈদুল ফিতরের আগের দিন ১০ এপ্রিল সাভারের কমলাপুর এলাকার বাহেরটেকে নিজের কেনা জমি দেখতে গিয়ে বেধড়ক মারধরের স্বীকার হন মো. সামসুদ্দিন চৌধুরী নামের ৬৫ বছর বয়সী এক ব্যক্তি। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন মেয়ে এবং মেয়ের জামাই। বাধা দিতে গিয়ে মারধরের স্বীকার হন তারাও। মারধরে মেয়ের জামাই ফয়েজ আহমেদের হাতের লিগামেন্ট ছিঁড়ে যায় এবং সামসুদ্দিন চৌধুরীর একটি চোখ নষ্ট হয়ে যায়। সামসুদ্দিনের মেয়ে সেলিনা বেগমও মারধর থেকে রক্ষা পাননি। স্থানীয় লোকজন এগিয়ে এলে প্রায় এক ঘণ্টা পর তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।

ওইদিনের ঘটনা সম্পর্কে ভুক্তভোগী সেলিনা বেগম বলেন, তিনি আমাদের জমি কম দামে কিনতে চেয়েছিলেন। জমি বিক্রি না করায় তিনি আমাদের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন।মিল্টন সরকারি রাস্তায় বাঁশ দিয়ে বেড়া দিয়ে রেখেছে। যে কারণে আমাদের গাড়ি যাচ্ছিল না। পরে সরকারি রাস্তায় বেড়া দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে তার লোকজন আমাদের ওপর হামলা চালায়। প্রায় ২০ থেকে ২৫ জন লোক লাঠিসোঁটা নিয়ে এসে বেধড়ক মারধর করে। এরপর আমার বাবা আর স্বামীকে মিল্টনের আশ্রমের ভেতরে নিয়ে একটি রুমের মধ্যে আটকে রাখে। ওখানে ৩টি রুম পাশাপাশি, একটি থেকে আরেকটিতে যাওয়া যায়। ঘরে অনেক লাঠি, পাইপ ও ছুরি ছিল। তারা পাইপ দিয়ে একের পর এক মারধর করে। মিল্টন নিজে এসে একটু পরে তাকে মারধর করে। আমি তখন মিল্টনের পা ধরে তাকে আমার স্বামী ও বাবাকে ছেড়ে দিতে বললে আমাকেও বেধড়ক মারধর করা হয়। পরে লোকজন এগিয়ে এলে আমাদের ছেড়ে দেয়।

মিল্টন সমাদের নিজেকে মানবতার পথিক এবং বয়স্কদের সেবা করার দাবি করলেও তিনি নিজেই প্রবীণদের ওপর নির্যাতন চালান। মানবতার এই তথাকথিত ব্যবসায়ী হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তির প্রতিও দয়া দেখায়নি।মিল্টনের হাতে মারধরের শিকার ইঞ্জিনিয়ার ফয়েজ বলেন, আমার হার্টে রিং বসানো; আমার স্ত্রী এটা বারবার তাদের বলে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা আমার বুকে দফায় দফায় লাথি মারে। আমার স্ত্রী মিল্টনের হাতে-পায়ে ধরেও কাজ হয়নি।

মানবসেবার নামে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানে জনগণকে নির্যাতন করার জন্য মিল্টন সমাদারের একটি বিশেষ সন্ত্রাসী বাহিনী রয়েছে। যাদের মানুষের দানের টাকা দিয়ে পেলেপুষে রাখেন মিল্টন সমাদ্দার। জমি দখল ও নিজের আধিপত্য বজায় রাখতে এই বাহিনীকেই ব্যবহার করেন তিনি।

প্রকৌশলী ফয়েজ আরও বলেন, মিল্টন সমাদ্দার তার আধিপত্য বজায় রাখতে একটি বিশেষ সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তুলেছেন। যাদের মাসিক বেতনও দেওয়া হয়। এই সন্ত্রাসী বাহিনী বিভিন্ন ভূমি দখল ও আধিপত্য বিস্তার করে।

আরেক ভুক্তভোগী হেমন্ত রোজারিও বলেন, আমি গরিব মানুষ। মিল্টন আমার জমি কিনতে চায়। আমি বিক্রি করিনি আমার জমি জোর করে দখল করে বাড়ি তৈরি করা হয়েছে। বাধা দেওয়া আমাকে মেরে ফেলের হুমকি দিয়েছে। পরে তিনি আমাকে বলেন, তুমি ওই জমিতে আসবে না। এলে তোরে মাইরালামু।

নন্দন রোজারিও নামে আরেক ব্যক্তি বলেন, আমরা তাকে এখানে আশ্রম তৈরি করতে সাহায্য করেছি। আমার জায়গায় জিনিসপত্র রেখে আশ্রমের কাজ করেছে। ভালো কাজ করে বলে আমরা কিছু বলিনি। পরে দেখি এসবের আড়ালে তার অন্য উদ্দেশ্য। তিনি এখানকার খ্রিস্টানদের জমি দখলের উদ্দেশ্যে এসেছে। কেউ জমি বেচতে না চাইলেই তার ওপরে নেমে আসে নির্যাতন। ওর লোকজন তাকে মারধর করে।

এমনকি তার জৈবিক পিতাও মিল্টনের প্রহার থেকে রেহাই পাননি। মিল্টন ২০০১ সালে তার বাবাকে মারধর করে। স্থানীয়রা জানায়, ওই ঘটনার কারণে তাকে গ্রাম থেকে বের করে দেওয়া হয়।

মিল্টন সমাদ্দার গ্রামের শাহাদাত হোসেন পলাশ নামে এক ব্যক্তি জানান, মিল্টন সমাদ্দার তার বাবাকে মারধর করে। এ কারণে তাকে গ্রাম থেকে বিতাড়িত করা হয়। পরে সে ঢাকায় পালিয়ে যায়। এখন শুনছি, ও না কি মানবতার ফেরিওয়ালা। এটা শুনে আমরা আশ্চর্য হয়েছি।

বরিশালে ‘চন্দ্রকোনা খ্রিস্টান মিশনারি চার্চ’ দখল চেষ্টার অভিযোগ রয়েছে মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে। দখলের উদ্দেশ্যে তিনি ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সিল-স্বাক্ষর জাল করে চার্চের নতুন কমিটি গঠন করে বরিশাল জেলা প্রশাসকে একটি চিঠি দেন। ওই কমিটিতে সভাপতি করা হয় মিল্টন সমাদ্দারকে। কমিটির বাকি সদস্যদের প্রায় সবাই মিল্টনের পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়স্বজন। তবে এ বিষয়ে কিছুই জানতেন না চার্চের দায়িত্বরত যাজকরা। পরে তারা ধর্ম মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করলে মন্ত্রণালয় থেকে তাদের জানানো হয়, এ ধরনের কোনো চিঠি ইস্যু করা হয়নি। এরপর তারা কোর্টে মামলা করলে কোর্ট জালিয়াতি করে চার্চ দখল করতে চাওয়া ব্যক্তিদের ওই চার্চের সীমানায় প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেন।

হেনসন দানিল হাজরা নামে এক সহকারী যাজক কালবেলাকে বলেন, চার্চ দখল করার জন্য আমাকে গুম করে যাজকদের নামে মামলা দিয়েছিল মিল্টন। মামলায় আমি গুম হয়ে গেছি দেখানো হয়। আসামি করা হয় আমার সহকর্মীকে। আমার বাবাকে ম্যানেজ করে মিল্টন এ কাজ করে। তারা আমাকে গুম করে ফেলতে চেয়েছিল; কিন্তু পারেনি। পরে আমি পালিয়ে এসপি অফিসে হাজির হয়ে জানাই, আমি গুম হইনি।

তিনি আরও বলেন, মিল্টন ও তার বড় ভাই মোল্লা মসজিদের পাশের বাড়ির ব্রিজে একবার আমাকে মারধর করে।

আরেক ধর্মযাজক বলেন, মিল্টন সমাদ্দার এই গির্জা দখলে নিতে আমাদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করেন। মারধর করে চুরি, ছিনতাই, ছিনতাইসহ একাধিক মামলা দিয়ে হয়রানি করেছে। তবে সব মামলাই আদালতে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। আমরা মামলা থেকে খালাস পেয়েছি।

দৈনিক কালবেলা দুটি খবরের শিরোনাম করেছে: মিল্টন সমাদ্দার, মানুষের মুখোশের আড়ালে ভয়ানক ব্যক্তি এবং জীবনের ধাপে ধাপে প্রতারণা। এরপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাকে নিয়ে শুরু হয় সমালোচনার ঝড়। ভুক্তভোগীরা মুখ খুলতে শুরু করেন।

About Nasimul Islam

Check Also

টাকার বিনিময়ে মাকে ম্যানেজ করে মেয়ের সাথে খারাপ কাজ

রংপুরের গঙ্গাচড়ায় গ্রামের কবিরাজ আবদুল খালেকের বিরুদ্ধে এক প্রতিবন্ধী গৃহবধূকে কৌশলে বাড়িতে নিয়ে ধ*র্ষণের অভিযোগ …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *